রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১
আমরা নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা একটু একটু করে জমিয়ে একটা স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণ করি। সেই কষ্টে অর্জিত বাড়িটি যদি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণার অভাবে ক্ষয়ের সম্মুখীন হয়, তাহলে সেই পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক।
আমরা প্রায়ই দেখি ভবনের দেয়ালে নোনা অর্থাৎ সাদা সাদা আস্তরণ পড়েছে, যার দীর্ঘস্থায়ীত্বে দেয়ালে প্লাস্টার ঝড়ে পড়াসহ ফাটল পর্যন্ত ধরে। ফলে, দেয়ালের সৌন্দর্য হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিপদজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এভাবেই নিজের স্বপ্নের বাড়িটি আস্তে আস্তে নষ্ট হতে থাকে।
তাই আজকে আমরা জানবো ভবনের দেয়ালে নোনা ধরা প্রতিরোধ করার উপায় সম্পর্কে। দেয়ালে নোনা পড়ার মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে আমরা হয়তো অনেকেই জানি, কিন্তু সঠিক জ্ঞানের অভাবে নোনা ধরার ঘটনা এড়াতে পারি না।
দেয়ালে নোনা ধরে কেন?
এ পর্যায়ে প্রথমেই জানবো, নোনা ধরা বিষয়টা আসলে কী। স্বাভাবিকভাবে, আপনি আপনার বাড়িটিতে বা যেকোনো ভবনে পছন্দমতো রং করলেন। তার কয়েকবছর পরেই দেওয়ালের রঙ ধীরে ধীরে হালকা হয়ে যায় এবং দেয়ালের ওপর হালকা থেকে গাঢ় সাদা সাদা আস্তরণ বা চাদর পড়ে যায়। ফলে প্লাস্টার ঝড়ে পড়ে। ঠিক এই বিষয়টাই হচ্ছে দেয়ালে নোনা ধরা বা ড্যাম্প, যা দেয়ালের সৌন্দর্য ও স্থায়ীত্ব দুটোই নষ্ট করে। কারণ, এটি ইট বা পাথরের দেয়ালে সাদা সাদা লবণের অধঃক্ষেপ সৃষ্টি করে।
দেয়ালের এই নোনা ধরার পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেগুলো সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার কারণে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারি না। আর সেই কারণগুলো হলো নিম্নরূপ-
১. সঠিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে। আমরা যখন ভবন নির্মাণ করি তখনই পানি অপসারণের সঠিক ব্যবস্থা নিতে না পারলে তা দেয়ালে নোনা ধরার এক অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২. দেয়ালের মাঝে পানির লাইনের ছিদ্র দেখা দিলে এবং প্লাস্টারের মাঝে পানির লাইন থাকলে।
৩. দেয়াল নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণে যেমন সিমেন্ট, বালু ও পানিতে লবণের পরিমাণ ২.৫% এর অধিক হলে।
৪. দেয়ালে ব্যবহৃত ইট স্বাভাবিক পোড়ানোর মাত্রা থেকে কম পোড়ানো হলে এবং ইট তৈরিতে ব্যবহৃত মাটিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকলে।
৫. ঘরের মেঝে এবং মাঝখানের দেয়ালের সঠিক সিক্ততার স্তর না থাকলে।
৬. ঘরের মধ্যে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ না থাকলে।
৭. ভবন নির্মাণের গঠনগত ত্রুটির কারণে।
৮. দেয়ালের প্লাস্টার ভালোমতো শুকানোর আগেই রঙ করে ফেললে।
৯. ভবন নির্মাণকাজে লবণ জাতীয় দ্রব্যের বেশি ব্যবহার হলে। যেমন -সোডিয়াম সালফেট, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, নাইট্রেট, ক্লোরাইড ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেটের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার।
১০. ঝড়বৃষ্টির ফলে দেয়ালের গাথুনীতে পানি জমা হলে ও স্যাঁতসেতে আবহাওয়ার প্রভাবে নোনা ধরে।
দেয়ালে নোনা ধরলে দেয়াল নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। যেমন- নোনার আস্তরণের ফলে রঙসহ প্লাস্টার খসে খসে পড়ে, দেয়ালে ড্যাম্প থেকে অসংখ্য জীবাণু ছড়ায়, ঘরের মধ্যকার আসবাবপত্র, কাপড়চোপড়, কাগজপত্র নষ্ট হতে পারে, ধীরে ধীরে দেয়ালের মজবুতভাব দূর করে এবং দেয়াল তার সৌন্দর্য হারায়।
দেয়ালের নোনা ধরার ব্যাপারটা আমরা বাড়ি নির্মাণের শুরুতেই কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলেই পরিহার করতে পারি। তাছাড়াও প্রয়োজন সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের পরিবেশ। আমরা প্রধানত দুটি উপায়ে দেয়ালের নোনা ধরা প্রতিরোধ করতে পারি।
১. প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক উপায়ে
এ পদ্ধতিতে নোনা ধরা এড়ানোর বড় হাতিয়ার হলো সহজে পানি অপসারণের ব্যবস্থা রাখা। বাড়ি নির্মানের শুরুতেই এ ব্যাপারটি মাথায় রেখে বাড়ির চারপাশে ড্রেনের ব্যাবস্থা করতে হবে। ছাদের পানি দূর করার জন্য ছাদ প্রয়োজনমতো ঢালু এবং রেইন ওয়াটার পাইপ রাখতে হবে।
ভবনের প্রতিটা দিকে যে সূর্যালোক পৌছায় সেদিকে নজর দিতে হবে। কারণ তাতে দেয়ালের স্যাতসেতে ভাব দূর হয়। ফলে নিম্ন তাপমাত্রায় জলীয়বাষ্পের ঘনীভূতের কারণে দেয়াল ঘেমে যায়না।
এছাড়াও, দেয়ালে নোনা ধরা এড়াতে বাতাস খুবই প্রয়োজনীয়। এজন্য ভবনের যেসব রুমের ভিতরকার দেয়ালে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারবে না সেখানকার পরিবেশ যথেষ্ট শুকনো এবং বাতাসপূর্ণ রাখতে হবে।
ইটের পানি ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় যতটা সম্ভব বৃষ্টির পানি এড়ানো যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। ইটের গাঁথুনিতে ফ্ল্যাশ পয়েন্টিং ব্যবহার করলে পানি দেয়ালে জমতে পারে না।
আবার অনেকাংশে দেয়ালের সাথে ভেজা কিছু রাখলেও দেয়ালে নোনা ধরতে পারে। এজন্য বর্ষাকালে দেয়ালের যত্নে সিনথেটিক কাপড়ের পর্দা ব্যবহার করা উচিত যাতে বৃষ্টির ঝাপটাতে ভিজে গেলেও দ্রুত শুকিয়ে যায়।
২. কৃত্রিম উপায়ে দেয়ালের নোনা প্রতিরোধ
বেশ কিছু কৃত্রিম উপায় রয়েছে যেগুলো অবলম্বন করলে নোনা ধরা দূর করা যায়। যেমন-
১. গাত্রক পানি নিরোধক অবস্থার মাধ্যমে। এ পদ্ধতিতে নোনা ধরা প্রতিরোধ করা হয় মূলত দুটি উপায়ে গাত্রক নিরোধক ব্যবহার করে। যেমন – ভিতর দিকের গাত্র, বাইরের দিকের গাত্র।
ভিতরের দিকের তুলনায় বাইরের দিকের গাত্রে বেশি পানি আসে যার জন্য বাইরের দিকটিতে গাত্রক পদ্ধতি বেশি প্রয়োজনীয় এবং কার্যকরী। এ পদ্ধতিতে ইটের জোড়ার মুখগুলো খুলে পয়েন্টিং করা হয়। পরবর্তীতে ভালোমতো প্লাস্টার করাতে হবে। উল্লেখ্য, এ কাজটি ২-৩ বছর পর পর করতে হয়।
২. পানি নিরোধক আচ্ছাদন ব্যবহার করে দেয়ালের নোনা ধরা প্রতিরোধ করা যায়। এজন্য বিটুমিন শীট, প্লাস্টিক শীটের মতো অন্যান্য সিক্ততা প্রতিরোধক স্তর বা সিলার ব্যবহার করে নোনা ধরা দূর করা হয়। এ ধরনের সোলার ব্যবহারের ফলে দেয়ালে চিড় ধরেনা।
৩. ডেনসিফায়ার সিলার ব্যবহার করেও এই কাজটি করা যায়। এটি যেকোনো সময় ব্যবহার করা যায়, তাতে দেয়ালে নোনা ধরা বা না ধরার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।
বাজারে ডেনসিফায়ার সিলার হিসেবে লিথিয়াম সিলিকট টাইপের সিলার পাওয়া যায় যেগুলো দেয়ালের নোনা পরবর্তী সৃষ্ট ছিদ্র আস্তে আস্তে বন্ধ করতে সাহায্য করে। তাই নোনা ধরলে আপনি এই সিলারটি ব্যবহার করতে পারেন।
৪. হাউজ আ্যন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট কর্তৃক নোনা ধরার প্রতিরোধক হিসবে দুটি দ্রবণ উদ্ভাবন করেছে (HBRI-SP এবং HBRI-DPHBRI-DP)। এগুলো ব্যবহার করলে আপনার সখের বাড়িটি ভালো থাকবে। এই দ্রবণ দুটো ব্যবহার প্রক্রিয়া দেওয়া হলো-
নোনা ধরা জায়গার রঙ, চুন ঘষে ঘষে তুলে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
এরপর ঐ স্থানে HBRI-SP এমনভাবে ৩-৪ বার ব্যবহার করতে হবে যাতে জায়গাটি ভিজে যায়। এরপর একদিন পরে ওখানে রঙ, চুন ইত্যাদি দিয়ে প্রলেপ দিতে হবে।
উপরের এই একই প্রক্রিয়াতে HBRI-DP ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ যেকোনো একটি দ্রবণ ব্যবহার করলেই চলবে।
ইতিকথা
শুধুমাত্র একটু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আপনার সখের বাড়ি বা ভবনটি নোনার দখলে চলে যেতে পারে। ভবন নির্মানের সময় এবং নির্মাণের পরে কিছু বাড়তি সতর্কতা মানলেই নোনা ধরার সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারবেন।
বর্তমানে নোনা রোধের বিষয়টিকে বাড়ি নির্মাণের একটি অন্যতম অংশ ভাবা হয়। কারণ এই প্রক্রিয়াতেই আপনি আপনার বাড়িতের স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্য বাড়াতে পারবেন। বলা হয়, বাড়ির সৌন্দর্যই বাড়ির লোকের সৌন্দর্যের প্রতিফলন।