শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
বিবাহিতরা পড়তে পারেন। অবিবাহিত ব্যাচেরলরদের ভবিষ্যত জীবনে কাজে লাগবে।
[১]
বাসের হেল্পার ভাড়া বললো পঁচিশ টাকা। বললাম, ‘পঁচিশ টাকা মানে? বিশ টাকা দিয়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করি। পঁচিশ টাকা দেবো কেনো?’
আমার কথায় হেল্পারের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। থাকার কথাও না। আমাকে না নিলে তার বিশেষ কোন ক্ষতি নেই। আমার জায়গায় বসার জন্য বাসের বাইরে একঝাঁক যাত্রী অজগরের মতোন হাঁ করে আছে। আমি নেমে গেলেই মুহূর্তে পূরণ হয়ে যাবে আমার শূন্যস্থান। না গেলে বরং আমারই ক্ষতি। অত দূরের পথ। কখন না কখন আবার বাস আসে। হেল্পার চিল্লিয়ে বললো, ‘পঁচিশ টাকাই ভাড়া। টাকা না থাকলে নাইমা যান’। পঁচিশ টাকা ভাড়া শুনে মনে হয় আমার গত্রেই লেগেছে খালি। আর কেউ টু শব্দটাও করলোনা। দ্রব্যমূল্যের বাজারে অন্যায় আর অনিয়ম মানুষের গা সয়ে গেছে, না তাদের বোধ শক্তি লোপ পেয়েছে তা বুঝে উঠা মুশকিল। অগত্যা পঁচিশ টাকা ভাড়া গুণেই আমাকে ফিরতে হলো।
বাসায় ফিরেছি। প্রতিদিনই ফিরি। কাঁধে ব্যাগ। চোখে চশমা আর একরাশ ক্লান্তি নিয়ে। আমাকে দরোজা খুলে দেয় আমার স্ত্রী, মুক্তা। দরজা খুলেই সে সালাম দেয়। আমি ক্লান্ত ভীষণ। হনহন করে হেঁটে চলে আসি নিজেদের রুমে। মুক্তা এসে আমার কাছে দাঁড়ায়। বলে, ‘লেবুর শরবত করে দেই?’
ক্লান্তিতে আমার গা নুইয়ে আসে। ঘরে আসলেই আমি যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি। কথা বলতে পারিনা। মুক্তা আবার প্রশ্ন করে, ‘মাথাব্যথা করছে? রঙ চা করে দেই? লেবু আর আদা দিয়ে?’
আমি রঙ চা’র ব্যাপারেই সম্মতি জ্ঞাপন করি। অনেকটা রাজার হালতে, ইশারায়। মুক্তা ছুটে যায় রান্নাঘরে। তড়িঘড়ি করে চুলোয় পানি বসিয়ে দেয়। একফাঁকে কেটে নেয় এক ফালি লেবু আর খানিকটা আদা। মুহূর্তকাল পরেই সে ধোঁয়া উঠা কাপ হাতে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। চায়ের কাপ যে-ই না মুখে নিতে যাবো, ওমনি বিকট শব্দে কেঁদে উঠে আমার ছেলে, ফারহান। কান্নার সে কি আওয়াজ! কানের পর্দা যেন ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।
মুক্তা এক দৌঁড়ে এসে ফারহানকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চার কান্না থামানোর তার সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা! কিন্তু ফারহান, ও যেন কান্না না থামানোর পণ করেছে আজ। ফারহানের কান্নাতে আমার অসুবিধে হচ্ছে ভেবে মুক্তা তাকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেলো। ফারহানের কান্না তখনও থামেনি। মুক্তা একসুরে বলে যাচ্ছে, ‘ও বাবা আমার! আমার সোনা আব্বুটা! আর কান্না করেনা। এই দেখো, আম্মু তোমাকে কোলে নিয়েছি বাবাই। আর কান্না করেনা আমার বাবুটা। ওলে ওলে বাবা আমার!’ ফারহানের কান্না আর মুক্তার কান্না থামানোর সঙ্গীত- দুটোর যৌথ প্রযোজনা আমার মাথাব্যথাটা যেন আরো দ্বিগুণ বাড়িয়েই দিলো।
শরীর একটু হালকা লাগলে আমি ফোন হাতে নিয়ে বসি। দেয়ালের সাথে পিট ঠেঁকিয়ে প্রবেশ করি নীল সাদার ভার্চুয়াল জগতে। জগতটা অদ্ভুত মায়াময়! উত্তর আধুনিক সময়ে, আমাদের সকল সুখ-দুঃখের গল্প এই জগতের বাসিন্দারা জেনে যায়। আমরাই জানাই। আমাদের সুখে অন্যরা সুখী হয়। দুঃখে অন্যেরা বলে উঠে, ‘আহারে’।
আমি ফেইসবুক স্ক্রল করতেই থাকি...করতেই থাকি। ইতোমধ্যেই ফারহান আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। খেয়াল করলাম, মুক্তা খুব সযত্নে ফারহানকে শুইয়ে দিয়ে গেলো আমার পাশে। তার ছোট্ট মশারিটাও পেতে দেওয়া হলো। ফারহানকে শুইয়ে দেওয়ার পর মুক্তা খুব নিঁচু স্বরে, পাছে ফারহান জেগে যায় এই
ভয়ে, জিজ্ঞেস করলো, ‘খাবার কি এখনোই দেবো?’
একেবারে শুরুর ক্লান্তিটা যখন আর নেই, তখন কথা একটু বলাই যায়। মুক্তার প্রশ্নের জবাবে তাই বললাম, ‘একটু পরেই দাও’।
একটু পরে দেওয়ার কথা শুনে মুকবতা পুনঃরায় রান্নাঘরে ছুটে গেলো। সেই কবেই সে রান্না চড়িয়েছিলো কে জানে। ঠান্ডায় সবকিছু জমে বরফ হয়ে আছে নিশ্চয়। খাবারগুলো এবার গরম করার পালা। সে খুব সযত্নে তার কাজে গেলো। তার কাজ, যা সে প্রত্যহ করে। রুটিন মেনে। যাতে কোনোদিন ব্যত্যয় ঘটেনা।
একটু পরে সে আবার ছুটে এলো আমার কাছে। শাড়ির আছলে হাত মুছতে মুছতে বললো, ‘চিংড়ির ঝোল আর গরুর গোশত দুটোই করা আছে। দুটোই গরম করবো?’
আমি তন্ময় হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা লেখা চোখের সামনে। অন্তত আমার কাছে। আমার এক বন্ধু, যার সাথে ফেইসবুকেই আমার পরিচয়, তার লেখা। তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে আজ। ডিভোর্স পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সে খুব আবেগময় করে তুলে ধরেছে। প্রচন্ড ভালোবাসতো একজন অন্যজনকে। এরপর, কি থেকে যে কি হলো। ডিভোর্স! খুব কষ্টই লাগলো। তাদের দু’জনের জন্যই।
মুক্তা আবার বললো, ‘শুনছো? তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি’।
আমি মাথা তুলে মুক্তার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘কি?’
-‘চিংড়ি আর গোশত দুটোই করা আছে। দুটোই গরম করবো কিনা জানতে চেয়েছি। নাকি দুটোর যেকোন একটা?’
বেশ রাগ উঠলো। এটা কোন প্রশ্ন হলো করার মতো! গলা উঁচু করে, একটু জোর শব্দেই বললাম, ‘যেকোন একটা করলেই তো পারো। এটা জিজ্ঞেস করার জন্য তো কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়না’।
মুক্তা চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। এরই ফাঁকে আমি আবার সেই লেখায় মনোনিবেশ করেছি। সেই লেখায় যেখানে আমার বন্ধু তুলে ধরেছে একটা সংসার ভাঙার কাহিনী। এতোদিনের একটা সংসার কিভাবে ভেঙে গেলো সেই দৃশ্যপট খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে আমার বন্ধুটা। খানিক বাদে মুক্তা আবার বললো, ‘সেদিন তুমি চিংড়ির ঝোল খেতে চেয়েছিলে। আমার জ্বর থাকায় রান্না করা হয়নি। তাহলে চিংড়িটাই গরম করি?’
মুক্তার কথাগুলো আমার মনোযোগে বেশ বিঘ্ন ঘটালো। সারাদিন কাজের মধ্যে থাকি। কাজ সেরে বাসায় ফিরেও শান্তি নেই। জেরার পর জেরা। বাবা আমি তো মানুষ, তাইনা? রোবট তো নই। আমারও তো একটু একান্ত সময় দরকার। কিছু একান্ত মুহূর্ত!
মুখে বিরক্তির সর্বশেষ রেখাটি ফুটিয়ে তুলে বললাম, ‘জানোই যখন আমি চিংড়ির ঝোল খেতে চেয়েছি, সেটা তাহলে বারেবারে জিজ্ঞাসা করছো কেনো? চিংড়িটাই গরম করে নিলে পারো’।
আমার বিরক্তিভরা উত্তরে মুক্তা এবার দমে গেলো। সত্যি সত্যিই দমে গেলো। ধীর পায়ে সে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। দরোজার যে জায়গায় রেবেকা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, সেখানে এখন একটা পর্দা দুলছে। মুক্তার প্রস্থানে শূণ্যে তৈরি হওয়া হাওয়ায়। আর আমি? আমি আবারও ডুব দিয়েছি নীল সাদার জগতে।
খাওয়া-দাওয়া পর্বের একেবারে মাঝামাঝি পর্যায়, আবারও ফারহানের সেই গগনবিদারী চিৎকার। সেই কান ফাঁটানো কান্নার আওয়াজ। আমার তাতে কোন অসুবিধা হয়না অবশ্য। বেশ খেতে হয়েছে চিংড়ির ঝোলটা। আমি আরাম করে খাচ্ছি। আর মুক্তা? ফারহানের কান্নার শব্দ শুনে সে কোন ফাঁকে যে হাওয়ায় উড়ে ফারহানের কাছে চলে গেলো, আমি টেরই পেলাম না। আবারও সেই একই সুর। একই সঙ্গীত। ‘ও বাবা আমার! আমার সোনা আব্বুটা! আর কান্না করেনা। এই দেখো, আম্মু তোমাকে কোলে নিয়েছি বাবাই। আর কান্না করেনা আমার বাবুটা। ওলে ওলে বাবা আমার!’
সকাল হয়। আমি অফিসের জন্য বের হই। আমার যা যা দরকার, সবকিছুই হাতের কাছে পাওয়া যায়। মুক্তা এনে রাখে। প্রতিদিন। নিয়ম করে। আজও ব্যত্যয় হয়নি। সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণ, যতক্ষণ আমি তার দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য না হই। এটাই হলো রোজকার জীবন। আমার...আমাদের।
[২]
এপাশ ও’পাশ দোলুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে আমাদের ট্রেন। আমি ছুটে যাচ্ছি মুক্তার কাছে। আমার হাতে ফুলের তোড়া। বেলি আর কাঠগোলাপ ফুলের সমন্বয়ে বানানো। বেলি ফুল মুক্তার পছন্দ, আর কাঠগোলাপ আমার। তার মাঝাখানে একটা চিরকুট।
তাতে লেখা- ‘I Love You’...