রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১
ছবি তোলা অনেক তরুণেরই আগ্রহের বিষয়। মুঠোফোনে শখের বশে ছবি তুলতে তুলতে অনেকেই হয়ে ওঠেন পেশাদার আলোকচিত্রী। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ছবি তুলে আয়ও করছেন অনেক শিক্ষার্থী। পড়ুন এমনই কয়েকজনের কথা। প্রতিবেদনটি করেছে দৈনিক প্রথম আলো।
সাদিয়া ইসলাম, টেক্সটাইল ও ক্লোদিং বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স
ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় মুঠোফোনে ছবি তুলতাম। পরে ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে দেন বাবা। সেই ক্যামেরা দিয়েই শখের বশে ছবি তোলার কাজ শুরু। পেশাগতভাবে আমি মূলত বিয়ের অনুষ্ঠানে ছবি তুলি, বিশেষ করে আউটডোরে। একসময় বিয়ের ছবি মানেই ছিল সেজেগুজে মঞ্চে কাঠ হয়ে বসে পোজ দেওয়া। সেই দিন আর নেই। বিভিন্ন পার্ক, নানা স্থাপনাকে পটভূমিতে রেখে আমি আমার ছবিকে আরও নান্দনিক করার চেষ্টা করছি। মানুষ হিসেবে আমি একটু অন্তর্মুখী। এ পেশায় এসে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। এখন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এটাও কিন্তু দারুণ একটা অভিজ্ঞতা।
আমার জীবনে প্রথম আয়ও বিয়ের ছবি তুলেই—মাত্র ২৫০ টাকা। ৫০০ টাকা পারিশ্রমিকে একটি অনুষ্ঠানে আমরা দুই বন্ধু কাজ করেছিলাম। সেই টাকাই পরে দুজন ভাগ করে নিয়েছি। এখন একটা ছোট দল নিয়ে আমরা নানা থিমে ছবি তুলি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের কিছু ছবি বেশ আলোচনায়ও এসেছিল।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়ার সুযোগ না পেলেও বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়ে নিজেকে তৈরি করেছি। এ ছাড়া কয়েকটি প্রদর্শনীতেও অংশ নিয়েছি। যেহেতু টেক্সটাইল ও ক্লোদিং নিয়ে পড়ছি, ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা আছে।
নিশান আহমেদ, পরিবেশবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৬ সাল থেকে আমি ফটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত। টাকাপয়সা জমিয়ে ক্যামেরা কিনেছিলাম, সেই থেকে শুরু। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত ডাক আসত। বিভিন্ন ক্লাবের অনুষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক আয়োজনসহ নানা উপলক্ষে হাজির হয়ে যেতাম ক্যামেরা হাতে। এসব ছবি তুলতে তুলতেই হাত পাকিয়েছি বলা যায়। প্রথম দিকে পরিবার খুব একটা সমর্থন দেয়নি, কিন্তু এখন মানসিকতা বদলেছে। আগ্রহটাকে সবাই গুরুত্ব দেয়। এখন নিয়মিত বিভিন্ন বিয়ের আয়োজন, করপোরেট অনুষ্ঠানে ছবি তুলি।
তবে এ যাত্রায় একটা ঘটনার বড় অবদান আছে। একবার এক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় খুব আগ্রহ নিয়ে ছবি জমা দিয়েছিলাম। প্রথম পুরস্কার পেয়ে যতটা আনন্দ হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের স্বাক্ষর করা একটি বই পেয়ে। এ পুরস্কারই আমার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। এখন প্রতিনিয়ত নিজের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। ড্রোনের মাধ্যমে ভিডিওগ্রাফির মতো চ্যালেঞ্জিং ও ভিন্ন ধরনের কিছু করার চেষ্টা করছি। ড্রোন পাইলট হিসেবেই আমি নানা দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করি। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে আলোকচিত্র–সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা আছে।
তকী তাজওয়ার রহমান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস
নিজের জমানো টাকা আর পরিবারের সমর্থন এক করে কিনেছিলাম প্রথম ক্যামেরা। ছবি তোলাটা আমি ভীষণ উপভোগ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব অনুষ্ঠানেই ছবি তোলার জন্য ডাক পড়ে। এই সুযোগে সৃজনশীলতার চর্চা যেমন হচ্ছে, তেমনি নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগও পাচ্ছি।
জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের জন্য আয়োজিত একটি আলোকচিত্র উৎসবে প্রথম পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে কাজের সুযোগ হয়। এরপর আরও অনেক কাজেই ডাক এসেছে। দেশি-বিদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য ছবি তোলাতেই আমার আগ্রহ। এর মাধ্যমে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়, শেখাও যায়। ২০২০ সালে আভাস নামের একটি ব্যান্ডের গান প্রকাশের অনুষ্ঠানে কাজ করেছিলাম। সেই কাজ করতে গিয়েও অনেক কিছু শিখেছিলাম। যেহেতু সাংবাদিকতায় পড়ছি, ভবিষ্যতে ফটোগ্রাফি আর সাংবাদিকতা—দুটো এক করে ক্যারিয়ার গড়তে চাই। আপাতত বিভিন্ন কর্মশালা, প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে নিজেকে তৈরি করছি।
আশরাফুল আলম, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ
ছিলাম কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্র। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। কিন্তু ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ থেকেই আমি কম্পিউটারবিজ্ঞান ছেড়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হই। ছবি তুলতে ভালো লাগত অবশ্য তারও অনেক আগে থেকে। কলেজে পড়ার সময় টিফিনের টাকা আর ঈদের সালামির টাকা জমিয়ে ক্যামেরা কিনেছিলাম।
আরও অনেক আলোকচিত্রীর মতো বিয়ের ছবি তুলেই আমার পেশাদার কাজের শুরু। সম্মানী পেয়েছিলাম ৫০০ টাকা। এরপর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের জন্য এককভাবে কাজ শুরু করি। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার হয়েও কাজ করেছি।
এখন ক্লাসরুমে যা শিখছি, সেটা আমার আগ্রহের জায়গায় কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছি। আমার আগ্রহ আছে বলেই ক্লাসের পড়াটাও উপভোগ করছি। এই ফাঁকে বেশ কয়েকটি দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছি। ক্যামেরার শক্তি অনেক। অনেক না বলা কথা, লুকানো বিষয়কে আমাদের সামনে তুলে ধরতে সাহায্য করে। আমি এ শক্তিই কাজে লাগাতে চাই।
তাসাওয়ার ইসলাম, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
২০১৪ সালে শখের বশে ফটোগ্রাফির শুরু। পেশাদার কাজ শুরু করি ২০১৯ সালে। প্রথম একটি সিরামিক কোম্পানির জন্য ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম। শুরুতে মুঠোফোনে ছবি তুলতাম। তখন চারপাশের জীবন, আমার ক্যাম্পাসের চিত্র—এসবই প্রাধান্য পেত। ছবি তুলতে তুলতেই একটু একটু করে শিখেছি। এরপর নানা প্রতিষ্ঠানের জন্য তথ্যচিত্র তৈরি থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রকল্পে যুক্ত হতে শুরু করি। অনেক প্রতিষ্ঠানের হয়েই কাজ করেছি। ২০২১ সালে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেই প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হয়েছিলাম। এ অর্জন আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে।
নাজিফা রাইদাহ, সমাজবিজ্ঞান, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস
কলেজজীবনের পরই আমি বিভিন্ন স্টার্টআপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। স্ট্রিট ফটোগ্রাফি করছি সেই তখন থেকে। এ ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানে ছবি তুলে আয় করেছি। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ইনহাউস ফটোশুট থেকেও আয় হয়েছে। ফটোগ্রাফি করে আয় করা এখন আসলে বেশ কঠিন। কারণ, জায়গাটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ। আবার অনেক সময় কাজ করেও টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না।
যেহেতু সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী, তাই সমাজের নানা দিকই আমার ছবিতে প্রাধান্য পায়। শুরুতে মুঠোফোনে ছবি তুলতাম, এরপর ক্যামেরা কিনে নিই। একবার ছবি তোলার সময় আমার ক্যামেরা হারিয়ে যায়। কী যে কষ্ট পেয়েছিলাম! আমার আগ্রহ দেখে তখন এক জ্যেষ্ঠ ফটোসাংবাদিক ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে টাকা তুলে ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। প্রকৃতিবিষয়ক ছবি তুলতে খুব ভালো লাগে। তবে ইচ্ছা আছে, ভবিষ্যতে আমার পড়ার বিষয়ের সঙ্গে ফটোগ্রাফি যুক্ত করে একটা কিছু করব।
সূত্র: প্রথম আলো