রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১

নারীর পোশাক নিয়ে হিপোক্রেসি

জীবন যাপন | ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান আগস্ট ১৪, ২০২৩, ১১:৫৫ এএম
নারীর পোশাক নিয়ে হিপোক্রেসি

দেশে নারীদের পোশাক ধীর লয়ে ক্ষুদ্র হয়ে আসছিলো। হঠাৎ করে সেই 'ধীর' এ প্রচন্ড গতি পেয়েছে। এখন ঢাকার রাস্তায় নিতম্ব বাহির করে দুই খন্ড কাপড় পরিহিতা দেখা যায়। স্বল্প পোশাকে অধিক আভিজাত্য -ইহাই দুনিয়ার আধুনিক নারীত্ব।

অনেকেই ভাবতে পারেন - মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুশাসনের অংশ হিসেবে এদেশে নারীরা বড় পোশাক পরেন। আসলে বিষয়টি আংশিক সত্য।

২০১৬ সালে চেন্নাইতে (ইন্ডিয়া) একটা ট্রেনিংয়ে গেলাম। ২৯ দেশের প্রতিনিধিদের সেই ট্রেনিংয়ে উজবেকিস্তানের দুইজন মেয়ে ছিলো, যারা মুসলমান। প্রথম দিনের ওরিয়েন্টেশন এ তারা হাফ প্যান্ট পরে উপস্থিত হলেন। প্রোগ্রাম শেষে ডরমিটরীতে ফেরার পথে কথা বললাম এবং তাদেরকে সাউথ এশিয়ার কালচার, বিশেষ করে মুসলিমদের কালচার সম্পর্কে অবহিত করলাম। তাদের সংগে আনা অধিকাংশ পোশাকই খুব ছোট, তাই তারা দুয়েকদিনের মধ্যে কিছু লম্বা কাপড় কিনবে বলে আমাকে জানালো এবং সেদিনের পরে আর কখনো এতো ছোট কাপড় তারা পরেন নি।

২০১৯ সালে চীনের শিচুয়ান প্রদেশে একটা ট্যুরের আয়োজন করলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রমযানের মধ্যে সেই ট্যুরে বাংলাদেশের তিনজন প্রতিনিধি ছিলাম। মোট ৩২ জনের সেই ট্যুরে চার দেশের চার জন লোক রোজা পালন করলাম। পাকিস্তানের একজন মেয়ে, তাজিকিস্তান এর একজন মেয়ে, ইন্দোনেশিয়ার একজন ছেলে ও আমি। প্রথম দিনের লাঞ্চ এর সময়ে যখন আমরা চারজন রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে কথা বলছিলাম - তখন তাজিকিস্তান ও পাকিস্তানের মেয়েরা খুবই বিষ্ময় প্রকাশ করেছিলো, যারা মুসলমান হয়েও রোজা পালন করছেন না - তাদের বিষয়ে। আমি বিষয়টিকে যার যার ধর্মীয় অনুভূতি হিসেবে এড়িয়ে গেলাম এবং ধর্মের প্রতি তাদের অনুভূতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। কিন্তু পরের দিন সকালে ট্যুরে যাওয়ার সময়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতেই কষ্ট হচ্ছিলো তাজিকিস্তানের সেই রোজাদার কে দেখে। একটি কোয়ার্টার প্যান্ট আর হাফ গেঞ্জি গায়ে তিনি বের হয়েছেন।

তাহলে মুসলিম হলেই যে পৃথিবীব্যাপী মেয়েরা লম্বা পোশাক পরেন - সেটা পুরোপুরি সঠিক নয়। তবে অনেকটাই সঠিক। রাশিয়া হতে স্বাধীন হওয়া দেশের মুসলিম নারীরা পোশাকের ক্ষেত্রে  তাদের আগের সংস্কৃতি ধরে রেখেছেন। তারা মুসলিম এবং ইসলামের অন্যান্য অনুশাসন মেনেও চলেন। অন্যদিকে সাউথ এশিয়ার অনেক স্থানে- বিশেষ করে বাংলাদেশ, কোলকাতা (ইন্ডিয়া), ভুটান এসব দেশের অমুসলিম লোকেরাও বেশ লম্বা কাপড় পরিধান করেন।

যাইহোক, আমাদের দেশের অনেক মেয়েই দেশী সংস্কৃতি ছেড়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ধাবিত হচ্ছিলেন অনেক দিন ধরেই। ওড়না এখন নেই বললেই চলে। হরেক রকমের ছোট পোশাকে, হাতে সিগারেটসহ মেয়েদেরও রাস্তায় দেখা যায়।

আমার মূল আলোচনা আসলে সেটা নয়।

আমার চোখ সমাজের সুধীমহল এর দিকে। যখন এ ধরনের ফটো সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ আপলোড দেন - সমাজের অনেক উঁচু স্তরের অনেককেই তপোদ্ধোনি দিতে দেখি।
একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে অস্ট্রেলিয়ার একটা বিশ্ববিদ্যালয় হতে গ্রাজুয়েশন করলে তিনি মেয়েকে ধরে যে ফটো তুলেছেন, সেখানে মেয়েটি একটু বড় বিকিনি পরিহিত বলা যায়। সেই পোস্টের কমেন্টস এ যারা মাশাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, অভিনন্দন, আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন -তাঁদের অধিকাংশই সমাজের উচ্চ পর্যায়ের লোক।

এভাবে হাজার নমুনা দেয়া যেতে পারে। ছোট পোশাক পরিহিতাদেরকে সুধীমহল বাহবা দিচ্ছেন। আধুনিক, প্রগতিশীল প্রভৃতি বাহারী সম্ভোধনে ডাকেন।
তাহলে বিষয়টি হচ্ছে - এ ধরণের পোশাকে সমাজ  গররাজী নয়।

আমার আলোচনার মূল পয়েন্টটি এখানে। নারী পুরুষ যে কেউ কোনো অপরাধ কাজে জড়িত হতে পারেন। কেউ কোনো অপরাধ করলে - তাকে সেই অপরাধের যথাযথ শাস্তি দিবেন। কিন্তু আমরা দেখি- কোনো নারী যদি অপরাধ করে থাকেন, তখন তাঁর অপরাধ নিয়ে যত কথা হয়, তার চেয়ে বেশী আলোচনায় আসে তাঁর পোশাক!!

ডা. সাবরিনার কথা নিশ্চয়ই সবাই ভুলে যান নি। যে অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো, সে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে কিনা, বা প্রমাণিত হলে - কী শাস্তি হয়েছে, আমার জানা নেই। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর পোশাক নিয়ে, তাঁর বডি ফিগার নিয়ে, তাঁর কন্ঠ নিয়ে যে অসভ্যতার পরিচয় দিলো এদেশের সুধীমহল - সেটি আমার মুখ্য আলোচ্য। পোশাকের তুমুল আলোচনায় তাঁর মূল অপরাধ ঢাকা পড়ে গেলো। অথচ সারাবছর স্বল্প পোশাকীদের মাশাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বলে দোওয়া করেন।

তাহলে যে পোশাকে আপনি নারীকে বাহবা দিলেন, মডার্ণ বলে উঁচুতে উঠালেন। আজ তিনি কোনো অপরাধ করলেই তাঁকে চরিত্রহীনা বলে গালি দিবেন! তাঁর পোশাক নিয়ে কথা বলবেন! সেল্ফ কন্ট্রাডিকটরী এটিচিউট! এটা এক ধরনের হিপোক্রেসি এবং বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা।

ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান
পিএইচডি: হুয়াজং ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, চীন

Side banner