রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১
তখন আমি ১৪-১৫ বছরের গ্রামের মাঠ, পথ-প্রান্তর দাপিয়ে বেড়ানো এক দুরন্ত কিশোর। ছুটি গল্পের ফটিক চরিত্রের উজ্জ্বল উদাহরণ যেন আমি নিজেই। ছিলাম একরোখা, লিকলিকে গড়নের, মহল্লা থেকে মহল্লা ক্রিকেট ,ফুটবল ম্যাচ খেলে বেড়ানোর আমার একটা দল ছিল, কত্ত যে মজা করেছি তা বলে বোঝানো সম্ভবপর নয়, এটা শুধু চোখ বন্ধ করে অনুভব করার বিষয়। প্রচন্ড জেদী আর চ্যালেঞ্জ নিতে আগ্রহী ছিলাম সেই ছোটবেলা থেকেই।
সময়টা তখন ১৯৯৮ সাল- একদিন এক নিকটাত্নীয় ভাইয়ের নার্সিং এ চান্স না পাওয়ায় তাকে বাড়ির লোকজনের সামনে কটুক্তি করে বসলাম, প্রতিউত্তরে পেয়ে গেলাম নার্স হওয়ার চ্যালেঞ্জ। দুরন্ত মনে তখন একটাই চাওয়া পাওয়া ছিল- আর যাই হোক নার্সিং এ চান্স পেয়ে আমাকে এই চ্যালেঞ্জ জয়ী হতেই হবে। ২০০০ সালে এসএসসি তে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে ভর্তি হলাম রংপুর সরকারী কলেজে। ততদিনে বেশ সাহিত্যমনাও হয়ে গেলাম। স্থানীয় দৈনিক গুলোতে প্রায় দিনই ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প, নিবন্ধ ছাপা হতে লাগল। জুটে গেলো বেশকিছু সাহিত্যমনা বন্ধু। কৈশোরের সেই দুরন্তপনা থেকে হয়ে উঠলাম নব্য ছড়াকার,গল্পকার এক যুবক।
এতকিছুর পরও নার্সিং এ চান্স পাওয়ার সেই চ্যালেঞ্জ মন থেকে মুছে যায়নি তখনো। অবশেষে সার্কুলার হল, কাউকে না জানিয়ে নিজের জমানো টাকা দিয়ে রংপুর নার্সিং কলেজ থেকে ফরম পুরণ করলাম, পরীক্ষা দিলাম। শুধু ১০০ টা বৃত্ত ভরাট করতে যেটুকু সময় প্রয়োজন তার থেকে বেশী সময় আমার লাগেনি। হলেই কনফার্ম হয়ে গেছিলাম এই চ্যালেঞ্জ জয়ী হতে শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ৩ মাস পর বের হল রেজাল্ট। এমসিকিউ দিয়েই রেজাল্ট, কোন ভাইভা ছিলনা । ভাল মার্ক পাবার কারণে নার্সিং ইন্সটিটিউট, ঢাকায় (বর্তমানে ঢাকা নার্সিং কলেজ) এ চান্স পেলাম। বাসায় এসে জানালাম চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প। নানা বাধা ডিঙ্গিয়ে ২০০১ সালের ১৪ মে রাত ১০ টার হানিফ পরিবহনে চড়ে ঢাকার পথে নার্স হবার অভিপ্রায়ে রওনা দিলাম।
গ্রামের দূরন্ত ফটিক ইট পাথরের শহরের হাজারো বিধি নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।
ডিপ্লোমা জীবনের উপাখ্যান
১ম বর্ষের ক্লাস টিচার ছিলেন চির শ্রদ্ধেয় এন্থোনিয়া ডি কষ্টা ম্যাডাম। উনার মাঝে আমি ফটিকের মামীকে খুজে পেতাম। শাসন-বারণ, নিয়ম-নীতিমালায় জীবন যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। এত এত দরখাস্ত কেউ কি কখনো লেখাতে পারে ?? এখন বুঝি সেই সব দিনের প্রতিটি দরখাস্তের ভাঁজে ভাঁজে আজকের এই সুশৃঙ্খল জীবনের বীজ রোপিত হয়েছিল। প্রচন্ড ভয় পেতাম গীতশ্রী ঘোষ ম্যাডামকে। উনি নার্সিং ইথিক্স পড়াতেন। তার সেই পড়ানো ইথিক্স আজো প্রতি পদক্ষেপে পালন করার চেষ্টা করি। আমাদের ব্যাচেই প্রথম ৫৭ জন ছেলে ভর্তি হই ঢাকা নার্সিং কলেজে।
৪ বছরের ডিপ্লোমা শেষ হবার আগেই ইন্সটিটিউটের ক্যাশিয়ার নুরুল ইসলাম ভাইয়ের সহায়তায় চাকরি পেয়ে গেলাম। চাকরী জীবনে অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। সাহাবউদ্দিন মেডিকেল হয়ে এ্যাপোলো হসপিটাল আমার প্রাইভেট চাকরীর শেষ কর্মস্থল।
এরমধ্যে সাহাবউদ্দিন আর এ্যাপোলো সমন্ধে দু-একটি কথা না বললেই নয়। সাহাবউদ্দিন মেডিকেল থেকে আমি সহ ৪ জনকে NICVD তে পাঠানো হল ICU/CCU ট্রেনিং এ। ট্রেনিং শেষে আইসিইউ চালু হল। জীবনের প্রথম নার্স বান্ধব কর্মপরিবেশ ওখানেই পেয়েছিলাম। তখনকার ডাক্তারদের সাথে আজ পর্যন্ত আমাদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান আছে। আজ যখন ডাক্তার- নার্সের কনফ্লিক্ট দেখি তখন তাদের জন্য শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে যায়। সেখানে নার্সিং সুপার হিসেবে পেয়েছিলাম শ্রদ্ধেয় মনিরা খানম ম্যামকে। ম্যাডামের দেখানো পথ অনুসরণ করে জীবনে পেয়েছি অপার সফলতা।
এ্যাপোলো তে শিখছি রিয়েল নার্সিং। ওখানে কাজ না করলে জীবনে অনেক কিছু শেখার বাকি থাকত।
প্রবাস জীবন
২০০৮ সালের জানুয়ারীতে লিবিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে সরকারী চাকুরীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে সস্ত্রীক লিবিয়ায় পাড়ি জমাই। প্রাণপণ চেষ্টা করে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আরবি ভাষাটা রপ্ত করে নিলাম। খুব সুখেই দিন কাটতে লাগল। এর মধ্যেই অনেক লিবিয়ান বন্ধু জুটে গেল। হাসপাতাল ও বাহিরে খুব চমৎকার পরিবেশে দিন কাটাতে লাগলাম। ২০১০ সালে সংসারে নতুন অথিতির আগমণ ঘটল। "এ সুখের নেই কোন সীমানা" গানটা তখন প্রায়ই অবচেতন মনে গুন গুন করে গাইতাম।
ছেলের ১ম জন্মদিনেই ফাগুনের সেইদিনে আষাঢ়ের ঘনঘটার মত অন্যান্য উত্তাল আরব দেশের মত লিবিয়ায়ও সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হল। সূখের সাগরে শুরু হল ভাটার টান। সাজানো গোছানো এত সুন্দর দেশটা রণক্ষেত্র হয়ে উঠল। ন্যাটোর ফাইটার জেটের আওয়াজ শুনে ঘুমাতে যেতাম আর সকালে এ কে ৪৭ রাইফেলের গুলির আওয়াজে ঘুম থেকে উঠা নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে গেল। বোম্বিং আর গুলির আঘাতে মানুষের ছিন্ন ভিন্ন রক্তাক্ত শরীর হয়ে উঠল আমার কর্মক্ষেত্র। হাজার হাজার আহত মানুষের আর্ত চিৎকারে লিবিয়ার আকাশ বাতাস তখন রিক্ত।প্রতিদিন খবর পেতাম লিবিয়ান বন্ধুদের মধ্যে আজ ও নেই তো কাল আরেকজন। যুদ্ধের দিনগুলোতে এক এক করে স্বদেশী - বিদেশী সহকর্মীদের অনেকেই বাড়ি চলে যাচ্ছে কাউকে কেউ না জানিয়েই। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে গেলাম। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম ফ্লোরেন্সের অনুসারী হয়ে এভাবে যুদ্ধপীড়িত মানুষদের ফেলে যাবার জন্য নার্স হইনি , থেকে গেলাম যুদ্ধাহত মানুষদের সেবায়। যুদ্ধের প্রতিটি দিন যেন এক একটা বছর । দীর্ঘ ৮ মাস চলল তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধে আর্তদের সেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য পেলাম সম্মাননা। বাবার অসুস্থতা আর সরকারি চাকুরির টানে স্ত্রী-সন্তান সহ দেশে ফিরে আসলাম।
সরকারি চাকুরীতে যোগদান
২০১৩ সালের শেষ ব্যাচভিত্তিক নিয়োগে চাকুরি পেয়ে গেলাম। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ফলেই এই নিয়োগ। এই সফলতার রুপকার আসাদুজ্জামান জুয়েল ভাই সহ তৎকালীন নেতা কর্মীদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
পোস্ট বেসিক বিএসসি
২০১৬ সালে প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই পছন্দ অনুযায়ী বগুড়া নার্সিং কলেজে বি এস সি পড়ার সুযোগ হয়ে যায়। সামনে অপশন আসলে নিমিষেই পাবলিক হেলথ নার্সিং বিভাগ চয়েজ করলাম। পাবলিক হেলথের প্রতি ঝোক আগে থেকেই ছিল। স্বপ্ন দেখতাম নিপসম থেকে এমপিএইচ করার। চিরশ্রদ্ধেয় হেলাল উদ্দীন, মো: মনজুর হোসাইন, বাদশাহ মিয়া, আহসান হাবিব, গুলনাহার রিনা আরএ আলো স্যার / ম্যাম সহ আনিসুর রহমান স্যার, শিলা ম্যাম, আরশে ম্যাম, রুবি ম্যাম,তাহেরা ম্যাম, সুরভি ম্যাম সবার ভালোবাসা আর স্নেহধন্য হয়ে ৮০% এর উপরে মার্কস নিয়ে বিএসসি পাশ করলাম। মেধা তালিকায় হলাম ৩য়। স্ত্রী-সন্তানদের ত্যাগ এ ক্ষেত্রে কম ছিল না । বি এস সি'র সময়ই এই প্রথম তাদের ছেড়ে একা একা থাকা। তাদের অবদান অসামান্য।
স্বপ্নের নিপসমে যাত্রা
ইতিপূর্বে কোন ভর্তি পরীক্ষার জন্য এতটা পড়িনি যতটা নিপসমের জন্য পড়লাম। পরীক্ষার হলেই এতটা আত্নবিশ্বাস এসে গিয়েছিল যে হল থেকে বের হয়েই এক সহকর্মীকে বললাম " চলেন নিপসম হোস্টেল দেখে আসি"। সন্ধ্যায় রেজাল্ট বের হল। সহধর্মিণী ততক্ষনে রেজাল্ট দেখে ফোন দিয়ে জানাল চান্স পাবার খবর।দেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার স্বনামধন্য পাবলিক হেলথ প্রতিষ্ঠান নিপসম। সেই ডিপ্লোমার সময় থেকেই স্বপ্ন দেখতাম নিপসমে পড়ার। স্বপ্ন সত্যি হলো। নিপসমের মাল্টি ডাইমেনশনাল পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ আমার শিক্ষা জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে আমি মনে করি।
এত সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ আর সবাই এত হেল্পফুল যা আমি আগে কল্পনাও করিনি। ভেবেছিলাম এমবিবিএস, বিডিএস ডিগ্রিধারীদের সাথে পড়তে যাচ্ছি না জানি কি হয়। কিন্তু এখানে আসার পর মনে হয়নি যে উনি ডাক্তার আর আমি নার্স। এই পদবীর পরিচয় এখানে মূখ্য নয়। সবারই এখানে একটাই পরিচয় "সবাই নিপসমীয়ান"। আমাদের বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী, গুনীজন প্রফেসর বায়জিদ খোরশেদ রিয়াজ স্যারের হাতের ছোঁয়ায় পুরো নিপসম আজ আধুনিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, তিনি তার দক্ষ হাতে প্রতিষ্ঠানটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। দেশবরেণ্য প্রফেসর স্যারদের ক্লাস গুলো এত মন্ত্রমুগ্ধের মত গিলতাম যে ২ ঘন্টার ক্লাসও কম মনে হত। প্রফেসর জিয়া স্যার, প্রফেসর সামসুল স্যার, প্রফেসর সাইফুর রহমান স্যার সহ সকল প্রফেসর স্যার দের ক্লাসগুলো এত জ্ঞানগর্ভ ও মজার ছিল যে তার রেশ চলতেই থাকত। পরবর্তী ক্লাসের অপেক্ষায় থাকতাম সবসময়।
অনেক সুখ নাকি সহ্য হয় না তাইতো ১ম সেমিস্টার শেষ হতেই করোনার প্রকোপে লন্ডভণ্ড জনজীবন। ডিজিএনএম এর শিক্ষা ছুটি বাতিলের আদেশ পেয়েই দেরী না করেই কর্মস্থলে যোগ দিলাম। লিবিয়া যুদ্ধের মত আবারো করোনা যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে অবতীর্ণ হলাম। এই যুদ্ধে মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের জয়ী করেন। জয়ীর বেশেই নিপসমে ফিরে কোর্সটা যেন শেষ করতে পারি সেই দোয়ার আবেদন রইল।
কিছু কথা কখনো হয়নি বলা
কোন জাতিকে শেষ করে দিতে চাইলে তাদের মধ্যে শুধু বিভেদ সৃষ্টি করে দিলেই সব কাজ শেষ, বাকিটা তারা নিজেই করবে। সেই "ডিভাইড এন্ড রুল" গেম আমাদের মধ্যে চলছে। আজ আমরা এমপিএইচ/এমএসএন, বেসিক/পোস্ট বেসিক, সরকারি/বেসরকারি, ডিপ্লোমা/বিএসসি সহ নানা দল উপদলে বিভক্ত যা পেশার জন্য অশনি সংকেত। এই পেশার সকলের পরিচয় একটাই, সকল পরিচয় ছাপিয়ে একটাই পরিচয় আমরা সবাই নার্স- মানবতার সেবক।সব ভেদাভেদ ভূলে আসুন সবাই এক হই, নার্স পরিচয়েই গর্ববোধ করি।
দীর্ঘ প্রবাস জীবনে ১০-১২ টি দেশের নার্সদের সাথে কাজ করেছি, কর্মদক্ষতায় আমাদের নার্স গণ কোন অংশেই কম নন বরং বেশি। ফিলিপিনো নার্সদের মধ্যে সবথেকে বেশি যে গুণটি তাদের এগিয়ে রাখে তা হলো স্মাইলিং ফেস। একটু সুন্দর হাসি দিয়েই যে ভুবন জয় করা যায় তার জলন্ত প্রমাণ তারা। নানা বিভেদে জড়িয়ে সারারাত ফেসবুকে বিভেদ বিদ্বেষ দেখে রাতের ঘুম নষ্ট করে সকালে ডিউটিতে গেলে কার হাসি আসে বলুন?? এত এত বিভেদ আর না পাওয়ার বেদনায় আমরা আজ বিষণ্ণতায় ভুগছি। এই বিভেদ বিদ্বেষ এর সমাপ্তি না ঘটলে আমরা ভাল সেবা দিতে পারবা না কেউই।সব বিভেদ ভূলে একটু হাসুন। রোগীর সাথে ১ম সাক্ষাতটা হোক একটু হেসে, মমতা মাখানো কথা দিয়ে। তাহলে আমরাও একদিন ফিলিপিনো কেরালার নার্সদের মত বিশ্ব জয় করতে পারব বলে আমি মনে করি।
সেদিন হয়ত বেশি দূরে নেই যেদিন বাংলাদেশের নার্সদের চাহিদা বিশ্বজুড়ে তৈরি হবে। শুধু বিভেদ ভূলে আসুন সবাই এক পরিচয় দেই #আমি_নার্স_আমরা_নার্স।
ভাল থাকুন
ভাল রাখুন
বিভেদ কে না বলুন !!!
ধন্যবাদ অনুজ হাসান মাহমুদকে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য। দোয়া রইল।।
করোনা মুক্ত পৃথিবী দেখার প্রত্যাশায়.................
রাহাত আজিজ
নিপসম, ঢাকা।
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)